ধর্ম ও সমাজ সংস্কারক হিসেবে রাজা রামমোহন রায়ের অবদান বা দৃষ্টিভঙ্গি আলোচনা করো।
>>>>>>>>>>>>> উত্তর <<<<<<<<<<<<
রাজা রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩) ঊনবিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ সমাজ সংস্কারক ও আধুনিক ভারতের নবজাগরণের পথিকৃৎ। তিনি ধর্ম ও সমাজ সংস্কারের ক্ষেত্রে যুক্তিবাদ, মানবতাবাদ ও আধুনিক চিন্তাভাবনার সমন্বয় ঘটান।
১. ধর্মসংস্কারে রামমোহনের দৃষ্টিভঙ্গি:
(ক) ব্রাহ্ম ধর্মের প্রবর্তন:
রামমোহন রায় বিশ্বাস করতেন ঈশ্বর এক ও নিরাকার। হিন্দুধর্মের বহুদেবতাবাদ, মূর্তিপূজা ও অন্ধবিশ্বাসের বিরোধিতা করে তিনি ১৮২৮ সালে ব্রাহ্ম সমাজ গঠন করেন। এটি ছিল ভারতের প্রথম সংগঠিত ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন।
(খ) বেদান্ত দর্শনের প্রচার:
তিনি উপনিষদ ও বেদান্ত দর্শনকে যুক্তিবাদী ও আধুনিকভাবে ব্যাখ্যা করেন। ঈশ্বর, আত্মা, পরলৌকিকতা— এসব বিষয়ে যৌক্তিক ব্যাখ্যা প্রদান করেন।
(গ) সব ধর্মের প্রতি সহনশীলতা:
রামমোহন ইসলাম ও খ্রিস্টধর্ম অধ্যয়ন করেন এবং সব ধর্মের মর্ম উপলব্ধি করে আন্তঃধর্মীয় সৌহার্দ্য প্রচার করেন।
২. সমাজসংস্কারে অবদান:
(ক) সতীদাহ প্রথার বিলোপ:
রামমোহন রায়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে সংগ্রাম। তিনি এই নিষ্ঠুর প্রথার বিরুদ্ধে ইংরেজ সরকারকে রাজি করান এবং অবশেষে ১৮২৯ সালে লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক এই প্রথা নিষিদ্ধ করেন।
(খ) নারীশিক্ষা ও নারীর অধিকার:
রামমোহন বিশ্বাস করতেন নারী ও পুরুষ সমান। তিনি নারীশিক্ষা, বিধবাবিবাহ, সম্পত্তির অধিকার ইত্যাদি বিষয়ে সোচ্চার ছিলেন।
(গ) বহুবিবাহ ও বাল্যবিবাহের বিরোধিতা:
তিনি সমাজে প্রচলিত বহু বিবাহ ও বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে যুক্তিপূর্ণ মত প্রকাশ করেন এবং এগুলোর সংস্কারে উদ্যোগ নেন।
৩. আধুনিক শিক্ষার পৃষ্ঠপোষকতা:
রামমোহন বিশ্বাস করতেন যে সমাজের উন্নতির জন্য আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষার প্রয়োজন।
-
তিনি ইংরেজি, বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদকে শিক্ষার কেন্দ্রে আনার পক্ষে ছিলেন।
-
হিন্দু কলেজ, অ্যাংলো-হিন্দু স্কুল, স্কটিশ চার্চ কলেজ– এসব প্রতিষ্ঠার সাথে তিনি যুক্ত ছিলেন।
৪. সাংবাদিকতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা:
রামমোহন ছিলেন ভারতের প্রথম আধুনিক সাংবাদিকদের একজন। তিনি সমবাদ কৌমুদী (বাংলা), মিরাত-উল-আখবার (ফার্সি) ইত্যাদি পত্রিকার মাধ্যমে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও জনমত গঠনের কাজ করেন।
উপসংহার:
রাজা রামমোহন রায় ধর্মীয় উদারতা, যুক্তিবাদ, মানবতাবাদ এবং সমাজ কল্যাণের সমন্বয় ঘটিয়ে আধুনিক ভারতীয় সমাজ গঠনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। তাঁর চিন্তাধারা পরবর্তী ব্রাহ্ম আন্দোলন, নারী আন্দোলন ও শিক্ষাসংস্কারে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে। এজন্য তাঁকে যথাযথভাবেই “আধুনিক ভারতের জনক” বলা হয়।
0 মন্তব্যসমূহ