ভারতীয় রাজনীতিতে জাতির ভূমিকা আলোচনা কর।
১) ভূমিকা
ভারত একটি বহুজাতিক, বহুভাষিক এবং বহু-ধর্মীয় দেশ। এখানকার সমাজব্যবস্থায় জাতি (Caste) একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক উপাদান। ঐতিহাসিকভাবে জাতি একটি সামাজিক শ্রেণিবিন্যাসের ভিত্তি হলেও, বর্তমানে এটি রাজনৈতিক চর্চার একটি কার্যকর হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। ভারতের স্বাধীনতা-পরবর্তী রাজনীতিতে জাতি শুধু সামাজিক পরিচয় নয়, বরং রাজনৈতিক সংগঠনের, দাবি উত্থাপনের ও প্রতিনিধিত্বের একটি শক্তিশালী ভিত্তি হয়ে উঠেছে।
২) রাজনীতি ও জাতির সংযোগ
ভারতের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রতিটি নাগরিকের রাজনৈতিক অধিকার থাকলেও, তাদের রাজনৈতিক সচেতনতা, সংগঠিততা ও প্রতিনিধিত্ব প্রায়শই জাতি ভিত্তিক। রাজনৈতিক দলগুলি ভোটব্যাংক গঠনের জন্য নানা জাতিগোষ্ঠীকে আকর্ষণ করে এবং তাদের জন্য বিশেষ প্রতিশ্রুতি দেয়। জাতির ভিত্তিতে দলীয় টিকিট বণ্টন, মন্ত্রীসভায় অন্তর্ভুক্তি, এবং রাজনৈতিক প্রচারে জাতিগত আবেগ জাগিয়ে তোলার ঘটনা সাধারণভাবে দেখা যায়।
৩) গ্রামাঞ্চলে জাতির গুরুত্ব
গ্রামাঞ্চলে জাতিপ্রথা এখনো দৃঢ়ভাবে প্রভাব বিস্তার করে। গ্রামবাসীদের সামাজিক জীবন, বিয়ে, ধর্মীয় আচার এবং অর্থনৈতিক কার্যক্রম সবই জাতি নির্ভর। গ্রামীণ রাজনৈতিক চর্চায়ও জাতি একটি প্রধান ভূমিকা পালন করে। স্থানীয় স্তরের নির্বাচন (যেমন পঞ্চায়েত) থেকে শুরু করে বিধানসভা নির্বাচন পর্যন্ত, জাতিগত সংহতি ও সংখ্যাগরিষ্ঠতা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। অনেক সময় জাতির উপর ভিত্তি করে পোলারাইজেশন (ধর্ম বা জাতিতে ভাগ হওয়া) ঘটে থাকে।
৪) রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় জাতিসমূহের প্রবেশপথ
সংবিধানিক সংরক্ষণের ব্যবস্থা (SC, ST, OBC) জাতিসমূহের রাজনৈতিক অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করেছে। নির্বাচন ব্যবস্থা, চাকরি ও শিক্ষাক্ষেত্রে সংরক্ষণ পাওয়ার ফলে পিছিয়ে পড়া জাতিগোষ্ঠী রাজনৈতিক ব্যবস্থার অংশ হতে পেরেছে। বাহুজন সমাজ পার্টি (BSP), রাষ্ট্রীয় জনতা দল (RJD), সমাজবাদী পার্টি (SP) ইত্যাদি দলগুলো জাতি ভিত্তিক রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বের মাধ্যমে পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়গুলোর কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছে।
৫) রাজনৈতিক সক্রিয়তা ও জাতির বিরোধ
জাতির ভিত্তিতে রাজনৈতিক সংগঠন ও সংহতি গড়ে উঠলেও, অনেক সময় তা জাতিগত সংঘাত ও বিরোধের কারণ হয়। সংরক্ষণের দাবিকে কেন্দ্র করে জাঠ, পাতিদার, মারাঠা, গুর্জর প্রভৃতি জাতিগোষ্ঠীর আন্দোলন তার প্রমাণ। আবার কিছু রাজনৈতিক দল জাতিকে ভোটে ব্যবহারের হাতিয়ার করে একে উস্কানি দেয়, যার ফলে সামাজিক বিভাজন ও হিংসা সৃষ্টি হয়।
৬) জাতিপ্রথার মধ্যে রাজনীতির প্রভাব
রাজনীতি জাতিপ্রথাকে দু’ভাবে প্রভাবিত করেছে:
-
একদিকে এটি পিছিয়ে থাকা জাতিগুলির রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন ঘটিয়েছে।
-
অন্যদিকে রাজনীতি জাতিপ্রথাকে টিকিয়ে রেখেছে ও ব্যবহার করেছে। অনেক রাজনৈতিক দল জাতির উপর ভিত্তি করে প্রার্থী মনোনয়ন দেয়, ফলত জাতিগত অসাম্য ও বৈষম্যও এক প্রকার বৈধতা পায়।
৭) ভারতের রাজনৈতিক দলসমূহের জাতিগত ভিত্তি
ভারতের বহু দল জাতিগত পরিচিতি ও প্রতিনিধিত্ব-এর উপর ভিত্তি করে গঠিত:
-
BSP – দলিত ও অনগ্রসর শ্রেণির পক্ষে কাজ করে।
-
RJD ও SP – মূলত যাদব, মুসলিম ও ওবিসিদের উপর নির্ভর।
-
DMK ও AIADMK – তামিলনাড়ুর ড্রাভিডিয়ান জাতিগত গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করে।
-
Akhil Bharatiya Kshatriya Mahasabha, Kurmi Mahasabha, Dalit Panthers – জাতি ভিত্তিক আন্দোলন ও দলগুলোর দৃষ্টান্ত।
৮) মূল্যায়ন (Evaluation)
ভারতীয় রাজনীতিতে জাতির ভূমিকা একদিকে যেমন রাজনৈতিক অন্তর্ভুক্তি ও সামাজিক ন্যায়ের পথ খুলে দিয়েছে, অন্যদিকে এটি ভোটের রাজনীতি, বিভাজন ও সংঘাতের উৎস হিসেবেও পরিগণিত হচ্ছে। জাতিগত ভোটব্যাংক গঠনের প্রবণতা কখনও কখনও জাতীয় স্বার্থ ও সমতা নীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
অতএব, প্রয়োজন এমন একটি রাজনৈতিক সংস্কৃতির, যেখানে জাতিগত পরিচয় থাকবে, কিন্তু তা থাকবে সামাজিক ন্যায়ের জন্য, রাজনৈতিক বিভাজনের হাতিয়ার হিসেবে নয়।
0 মন্তব্যসমূহ