ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের গঠন, ক্ষমতা ও কার্যাবলী অপসারণ পদ্বতি আলোচনা কর।

ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের গঠন, ক্ষমতা ও কার্যাবলী অপসারণ পদ্বতি আলোচনা কর।

 ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের গঠন, ক্ষমতা ও কার্যাবলী অপসারণ পদ্বতি আলোচনা কর।


ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট (Supreme Court of India) হল দেশের সর্বোচ্চ ও চূড়ান্ত বিচারিক প্রতিষ্ঠান। এটি ভারতের সংবিধানের অভিভাবক এবং সর্বোচ্চ আদালত হিসেবে কাজ করে। নিচে এর গঠন, ক্ষমতা, কার্যাবলী ও অপসারণ পদ্ধতি বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হলো:


🏛️ ১. গঠন (Structure of the Supreme Court):

➤ সংবিধানের ধারা:

  • ভারতের সংবিধানের 124 নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্ট প্রতিষ্ঠিত।

  • এটি ১৯৫০ সালের ২৮ জানুয়ারি থেকে কার্যকর হয়।

➤ সদস্য সংখ্যা:

  • শুরুতে ছিল: ১ জন প্রধান বিচারপতি এবং ৭ জন সহকারী বিচারপতি।

  • বর্তমানে: ১ জন Chief Justice of India (CJI) এবং ৩৩ জন বিচারপতি, মোট ৩৪ জন বিচারপতি।

  • সদস্য সংখ্যা বাড়ানো হয় সংসদের আইন দ্বারা।

➤ নিয়োগ:

  • বিচারপতিদের নিয়োগ করেন রাষ্ট্রপতি, প্রধান বিচারপতির পরামর্শে এবং বিচারপতিদের একটি কলেজিয়াম পদ্ধতির মাধ্যমে।

➤ যোগ্যতা:

  1. ভারতের নাগরিক হতে হবে।

  2. হাইকোর্টে অন্তত ৫ বছর বিচারপতি হিসেবে কাজের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে অথবা অন্তত ১০ বছর হাইকোর্টে আইনজীবী হিসেবে প্র্যাকটিস থাকতে হবে।

  3. বিচার বিভাগীয় ক্ষেত্রে বিশিষ্ট জ্ঞান থাকলে রাষ্ট্রপতি তাকে মনোনীত করতে পারেন।

➤ অবসর বয়স:

  • সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতির অবসর গ্রহণের বয়স ৬৫ বছর


⚖️ ২. ক্ষমতা (Powers of the Supreme Court):

‌‌➤ (১) মূল এক্তিয়ার ক্ষমতা (Original Jurisdiction):

  • সংবিধানের 131 অনুচ্ছেদ অনুযায়ী:

    • কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে,

    • দুই বা ততোধিক রাজ্যের মধ্যে,

    • রাষ্ট্র ও কেন্দ্রীয় সরকারের মধ্যে কোনও বিরোধ হলে সেই মামলা সরাসরি সুপ্রিম কোর্টে দায়ের হয়।

➤ (২) আপিল বিচার ক্ষমতা (Appellate Jurisdiction):

  • দেশের যেকোনো হাইকোর্ট বা ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা যায়।

  • ফৌজদারি, দেওয়ানি ও সংবিধানগত মামলার আপিল শুনে।

➤ (৩) পরামর্শমূলক ক্ষমতা (Advisory Jurisdiction):

  • সংবিধানের 143 অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি কোন গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক বা আইনগত বিষয়ে মত চাইলে সুপ্রিম কোর্ট পরামর্শ দিতে পারে।

➤ (৪) সংবিধান ব্যাখ্যা করার ক্ষমতা:

  • সুপ্রিম কোর্টই সংবিধানের চূড়ান্ত ব্যাখ্যাকারী।

➤ (৫) রিট জারি করার ক্ষমতা:

  • সংবিধানের 32 অনুচ্ছেদ অনুযায়ী মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হলে রিট আদেশ জারি করতে পারে।

  • ৫ প্রকারের রিট: হেবিয়াস কর্পাস, ম্যান্ডামাস, কোও ওয়ারান্টো, প্রোহিবিশন, সার্টিওরারি।

➤ (৬) নজির স্থাপনকারী আদালত:

  • সুপ্রিম কোর্টের রায় ও সিদ্ধান্তসমূহ অন্য সকল আদালতের জন্য বাধ্যতামূলক (binding precedent)।


📚 ৩. কার্যাবলী (Functions of the Supreme Court):

⚖️ ১. ন্যায়বিচার প্রদান (Administration of Justice)

সুপ্রিম কোর্ট হল দেশের চূড়ান্ত আদালত। দেওয়ানি, ফৌজদারি এবং সংবিধান-সংক্রান্ত মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি করে। সাধারণ জনগণ, প্রতিষ্ঠান এবং সরকার — সবাই এর কাছে বিচার চাইতে পারে।


🏛️ ২. সংবিধান ব্যাখ্যার কাজ (Interpretation of the Constitution)

সুপ্রিম কোর্ট হল সংবিধানের চূড়ান্ত ব্যাখ্যাকারী। যেকোনো আইন বা সরকারের পদক্ষেপ সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কি না, তা নির্ধারণ করার অধিকার একমাত্র এই আদালতের রয়েছে।


🛡️ ৩. মৌলিক অধিকার রক্ষা (Protection of Fundamental Rights)

সংবিধানের ৩২ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, যদি কোনও নাগরিকের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হয়, তবে সে সরাসরি সুপ্রিম কোর্টে রিট পিটিশন করতে পারে। এর ফলে আদালত নিম্নলিখিত ৫ ধরনের রিট আদেশ জারি করতে পারে:

  1. হেবিয়াস কর্পাস

  2. ম্যান্ডামাস

  3. প্রোহিবিশন

  4. সার্টিওরারি

  5. কোও ওয়ারান্টো


🔍 ৪. বিচারিক পুনর্বিচার (Judicial Review)

সুপ্রিম কোর্টের একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হল আইন ও প্রশাসনিক আদেশ সংবিধানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কি না, তা পর্যালোচনা করা। এটি সংবিধানের মৌলিক কাঠামো রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।


📝 ৫. আপিল শুনানি (Hearing of Appeals)

সুপ্রিম কোর্ট হাইকোর্ট বা অন্যান্য ট্রাইব্যুনালের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে আপিল শুনে। ফৌজদারি, দেওয়ানি, সংবিধান সংক্রান্ত কিংবা বিশেষ ক্ষেত্রে যেকোনো রায়ের বিরুদ্ধে এখান থেকে শেষ আপিল করা যায়।


📜 ৬. পরামর্শমূলক ভূমিকা (Advisory Function)

সংবিধানের ১৪৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি কোনও গুরুত্বপূর্ণ আইনগত বা সাংবিধানিক বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের মতামত চাইতে পারেন। এই মতামত বাধ্যতামূলক না হলেও তা অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা হয়।


👨‍⚖️ ৭. নজির স্থাপন (Establishing Precedents)

সুপ্রিম কোর্টের রায় ও সিদ্ধান্তসমূহ ভবিষ্যতের জন্য উদাহরণ বা নজির (precedent) হিসেবে ব্যবহৃত হয়, যা অধঃস্তন সব আদালতের জন্য বাধ্যতামূলক।


🏢 ৮. প্রশাসনিক কার্যাবলী (Administrative Functions)

  • হাইকোর্টে বিচারপতি নিয়োগের সুপারিশ করা।

  • কিছু নির্দিষ্ট ট্রাইব্যুনালের কাজ পর্যবেক্ষণ।

  • রাষ্ট্রপতির অনুরোধে বিভিন্ন কমিশন ও প্রশাসনিক দিকনির্দেশনা দেওয়া।


❌ ৪. অপসারণ পদ্ধতি (Removal or Impeachment of Judges):

➤ প্রাসঙ্গিক ধারা:

  • সংবিধানের 124(4) ও 124(5) অনুচ্ছেদে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিকে অপসারণের পদ্ধতি নির্দিষ্ট করা হয়েছে।

➤ অপসারণের কারণ:

  1. দুরাচরণ (Misbehaviour) অথবা

  2. অক্ষমতা (Incapacity)

➤ অপসারণ পদ্ধতি (Impeachment Process):

  1. সংসদে প্রস্তাব:

    • লোকসভা অথবা রাজ্যসভায় কমপক্ষে ১০০ (রাজ্যসভা) বা ৫০ (লোকসভা) জন সদস্য স্বাক্ষর করে অপসারণ প্রস্তাব উত্থাপন করেন।

  2. প্রস্তাব গৃহীত হওয়া:

    • উভয় কক্ষে পৃথক পৃথকভাবে বিশেষ সংখ্যাগরিষ্ঠতা (2/3 সদস্যের উপস্থিতি ও ভোট) দ্বারা পাশ হতে হবে।

  3. রাষ্ট্রপতির আদেশ:

    • সংসদের উভয় কক্ষে প্রস্তাব গৃহীত হলে রাষ্ট্রপতি বিচারপতিকে অপসারণের নির্দেশ জারি করেন।

🔹 এখনও পর্যন্ত শুধুমাত্র সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের বিরুদ্ধে অপসারণ প্রস্তাব আনা হয়েছে, কিন্তু কাউকে সফলভাবে অপসারণ করা হয়নি।


🔚 উপসংহার:

ভারতের সুপ্রিম কোর্ট দেশের বিচারব্যবস্থার সর্বোচ্চ স্তম্ভ। এটি শুধুমাত্র আইনি সমস্যার সমাধান করে না, বরং সংবিধান রক্ষা, মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ এবং সরকারের ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা করে। সুপ্রিম কোর্টের গঠন ও ক্ষমতা বিচার ব্যবস্থার স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রকে সুদৃঢ় করে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ