ভারতীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থায় শ্রেণীর ভূমিকা আলোচনা কর।
ভূমিকা : -
ভারতের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় শ্রেণী (Class) একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক উপাদান, যা অর্থনৈতিক অবস্থান, সামাজিক মর্যাদা, শিক্ষা, সম্পদ ও পেশার উপর নির্ভর করে। শ্রেণী মূলত সমাজে ধনী ও গরিব, মালিক ও শ্রমিক, শহরবাসী ও গ্রামবাসী, উচ্চশিক্ষিত ও অশিক্ষিত—এই পার্থক্যের মাধ্যমে গঠিত হয়। ভারতের গণতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এই শ্রেণী পার্থক্য রাজনীতিতে অংশগ্রহণ, রাজনৈতিক চেতনা ও দাবিদাওয়া-কে গভীরভাবে প্রভাবিত করে।
🔍 ১) শ্রেণী ও রাজনীতির সংযোগ
-
ভারতীয় সমাজে শ্রেণীগত পার্থক্য রাজনৈতিক আচরণ ও অবস্থান নির্ধারণে ভূমিকা রাখে।
-
উচ্চবিত্ত শ্রেণী সাধারণত ক্ষমতাকেন্দ্রিক, অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী এবং রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখে।
-
নিম্নবিত্ত ও শ্রমজীবী শ্রেণী অধিকাংশ সময় রাজনৈতিক দলগুলির ভোটব্যাংক হিসেবে ব্যবহৃত হয়, যদিও ধীরে ধীরে তারা নিজেদের দাবি-দাওয়ার ভিত্তিতে সংগঠিত হচ্ছে।
⚙️ ২) অর্থনৈতিক শ্রেণী ও ভোট রাজনীতি
-
রাজনৈতিক দলগুলো বিভিন্ন আর্থিক শ্রেণীভিত্তিক ভোটারদের টার্গেট করে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি দেয়। যেমন:
-
নিম্নবিত্তের জন্য সাবসিডি, বিনামূল্যে খাদ্য, রেশন, ঘর ইত্যাদি।
-
মধ্যবিত্তের জন্য ট্যাক্স ছাড়, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সুবিধা।
-
উচ্চবিত্ত শ্রেণীর জন্য শিল্পনীতি, কর ছাড় ও বিনিয়োগের সুযোগ।
-
-
এসব শ্রেণীভিত্তিক প্রতিশ্রুতি রাজনৈতিক এজেন্ডা গঠনে মুখ্য ভূমিকা পালন করে।
🏙️ ৩) শহর বনাম গ্রাম: শ্রেণীর ভেদাভেদ
-
শহর ও গ্রামাঞ্চলের মধ্যে শ্রেণীভেদ রাজনীতিতে আলাদা আলাদা প্রভাব ফেলে।
-
শহুরে মধ্য ও উচ্চ শ্রেণী সচেতন, সোচ্চার ও নীতিনির্ধারণে প্রভাবশালী।
-
গ্রামীণ নিম্নবিত্ত শ্রেণী সাধারণত স্থানীয় রাজনীতিতে সক্রিয় এবং জাতি ও সম্প্রদায়ভিত্তিক ভোটদান প্রবণতা বেশি।
-
💪 ৪) শ্রেণী-ভিত্তিক আন্দোলন
ভারতে বহু রাজনৈতিক আন্দোলন শ্রেণী-ভিত্তিক হয়ে উঠেছে। যেমন:
-
শ্রমিক আন্দোলন: মজুরি বৃদ্ধি, নিরাপদ কর্মপরিবেশের দাবিতে।
-
কৃষক আন্দোলন: ঋণমুক্তি, ন্যায্য দামের দাবি, MSP নিয়ে প্রতিবাদ।
-
ছাত্র আন্দোলন: শিক্ষা ও বেকারত্ব সংক্রান্ত ইস্যুতে।
-
অবিচার-বিরোধী আন্দোলন: অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ।
এগুলো সরাসরি শ্রেণীভিত্তিক দাবি ও রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত।
🗳️ ৫) রাজনৈতিক দল ও শ্রেণী
-
বেশ কিছু রাজনৈতিক দল তাদের নীতিমালায় শ্রেণীগত স্বার্থ প্রতিফলিত করে:
-
বামপন্থী দলগুলি (যেমন CPI, CPM) – শ্রমিক ও কৃষকের স্বার্থে কাজ করে।
-
জনতা দল, সমাজবাদী দল – দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর প্রতিনিধি।
-
বিজেপি ও কংগ্রেস – নানা শ্রেণীর সমন্বয়ে বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে লক্ষ্য করে।
-
🤝 ৬) শ্রেণী ও রাজনৈতিক অংশগ্রহণ
-
নিম্নবিত্ত শ্রেণীর লোকজন সাধারণত ভোটদানে অধিক সক্রিয়, কারণ তারা নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির উপর বেশি নির্ভরশীল।
-
মধ্য ও উচ্চবিত্ত শ্রেণী কখনও রাজনৈতিকভাবে নিরুৎসাহী হলেও, সামাজিক আন্দোলন ও মিডিয়ার মাধ্যমে প্রভাব বিস্তার করে।
📊 ৭) শ্রেণী ও রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ
-
নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে উচ্চ শ্রেণীর প্রভাব অনেক বেশি। লবিং, কর্পোরেট চ্যানেল, মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদির মাধ্যমে তারা অর্থনৈতিক নীতি, শিল্পনীতি, শিক্ষা বা স্বাস্থ্য নীতিকে প্রভাবিত করে।
-
নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অংশগ্রহণ নির্বাচনী স্তরে বেশি হলেও, নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে তাদের প্রভাব তুলনামূলক কম।
✅ ৮) মূল্যায়ন
ভারতের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় শ্রেণীর ভূমিকা অত্যন্ত গভীর ও বহুমাত্রিক। একদিকে শ্রেণীগত বৈষম্য রাজনৈতিক অস্থিরতা, সংঘাত ও বঞ্চনার কারণ, অন্যদিকে শ্রেণীভিত্তিক দাবিদাওয়া গণতান্ত্রিক সচেতনতা বৃদ্ধি ও রাজনৈতিক সংগঠনের পথ খুলে দেয়।
তবে শ্রেণী রাজনীতির চূড়ান্ত লক্ষ্য হওয়া উচিত সামাজিক ন্যায় ও আর্থিক সমতা প্রতিষ্ঠা, যাতে সকল শ্রেণীর মানুষ সমান সুযোগ ও মর্যাদা লাভ করতে পারে।
✍️ উপসংহার
ভারতীয় রাজনীতিতে শ্রেণী একটি অপরিহার্য উপাদান। এটি শুধুমাত্র রাজনৈতিক দলগুলোর এজেন্ডা নির্ধারণে নয়, বরং সাধারণ মানুষের রাজনৈতিক সচেতনতা, আন্দোলন ও অংশগ্রহণে সরাসরি প্রভাব ফেলে। শ্রেণীভিত্তিক রাজনীতি গণতন্ত্রকে যেমন শক্তিশালী করতে পারে, তেমনই অসতর্ক ব্যবহারে তা বিভাজনের পথও খুলে দিতে পারে। তাই শ্রেণীর ভূমিকা যেন হয় সচেতনতা ও উন্নয়নের হাতিয়ার, বিভাজনের নয়।
0 মন্তব্যসমূহ