স্বামী বিবেকানন্দ কিভাবে ভারতীয় সমাজকে পুনরুজ্জীবিত করেছিলেন – আলোচনা
>>>>>>>>> উত্তর <<<<<<<<<<
স্বামী বিবেকানন্দ (১৮৬৩–১৯০২) ছিলেন উনিশ শতকের শ্রেষ্ঠ দার্শনিক, ধর্মপ্রচারক ও সমাজসেবক। রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের শিষ্য হিসেবে তিনি একাধারে ভারতীয় দর্শন, সংস্কৃতি ও ধর্মকে বিশ্বমঞ্চে তুলে ধরেন এবং ভারতীয় সমাজকে আত্মমর্যাদায় উজ্জীবিত করেন। তিনি এক নব্য জাগরণ সৃষ্টি করেছিলেন, যা ভারতীয় সমাজকে আত্মবিশ্বাস, গৌরব ও কর্মচেতনায় উদ্দীপ্ত করেছিল।
১. আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদার জাগরণ:
(ক) ভারতীয় সংস্কৃতির মাহাত্ম্য প্রচার:
স্বামী বিবেকানন্দ উপনিষদ, বেদান্ত ও গীতার মাধ্যমে ভারতীয় আধ্যাত্মিকতা ও সংস্কৃতিকে নতুন গুরুত্ব দেন।
তিনি বলেন:
"We are the children of God, sharers of immortal bliss."
(খ) গর্ববোধ ও আত্মবিশ্বাসের শিক্ষা:
তিনি পরাধীন, আত্মবিশ্বাসহীন ভারতীয়দের আত্মগরিমা ফিরিয়ে দিতে বলেন:
“উঠো, জাগো এবং লক্ষ্য না পাওয়া পর্যন্ত থেমো না।”
এই আহ্বান সমাজে নতুন চেতনার জন্ম দেয়।
২. ধর্মীয় ও সামাজিক পুনর্জাগরণ:
(ক) বেদান্তের আধুনিক ব্যাখ্যা:
বিবেকানন্দ হিন্দুধর্মকে যুক্তিবাদ ও বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে ব্যাখ্যা করে পাশ্চাত্য দার্শনিকদের দৃষ্টিভঙ্গি পালটে দেন।
তিনি দেখান হিন্দুধর্ম কোনো গোঁড়া ধর্ম নয়, বরং এক উদার ও সার্বজনীন জীবনদর্শন।
(খ) জাতপাত ও বিভেদের বিরোধিতা:
তিনি জাতপাত, ছুঁওয়াছুঁই, কুসংস্কার ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে দাঁড়ান।
-
তিনি বলেন, “যতদিন শত কোটি মানুষের মুখে খাবার তুলে না দেওয়া যায়, ততদিন ধর্মের কথা বলা পাপ।”
-
তিনি সেবাকে ধর্মের সঙ্গে যুক্ত করেন।
৩. যুবসমাজকে উদ্বুদ্ধকরণ:
(ক) যুবকদের জাগরণ:
স্বামী বিবেকানন্দ মনে করতেন যে যুবকরাই দেশগঠনের প্রধান শক্তি।
তিনি বলেন:
“Give me 100 energetic youth and I shall transform India.”
(খ) কর্মবাদ ও আত্মনির্ভরতার শিক্ষা:
তিনি ‘কর্মই ধর্ম’ – এই ধারণার প্রচার করেন এবং অলসতা, নিরাশা ও পরনির্ভরতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেন।
৪. শিক্ষা ও মানবসেবার পথপ্রদর্শক:
(ক) আদর্শ শিক্ষার ধারণা:
তিনি এমন শিক্ষার কথা বলেন যা জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত, চরিত্রগঠনমূলক এবং মননশীলতা গঠনে সহায়ক।
-
তিনি বলেন, “Education is the manifestation of the perfection already in man.”
(খ) রামকৃষ্ণ মিশনের প্রতিষ্ঠা (১৮৯৭):
সেবাকে ধর্ম রূপে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে তিনি রামকৃষ্ণ মিশন গঠন করেন।
-
এটি শিক্ষা, স্বাস্থ্য, দুর্যোগ মোকাবিলা এবং সমাজসেবায় আজও কাজ করে চলেছে।
৫. আন্তর্জাতিক অবদান ও জাতীয় চেতনা:
(ক) শিকাগো ধর্মসভায় বক্তৃতা (১৮৯৩):
স্বামীজির “Sisters and Brothers of America” দিয়ে শুরু হওয়া বক্তৃতা ভারতীয় সমাজকে আন্তর্জাতিক গর্বের জায়গায় পৌঁছে দেয়।
-
এতে বিশ্ব জানে ভারত কেবল দারিদ্র্য ও কুসংস্কারের দেশ নয়, বরং আধ্যাত্মিকতার আধার।
(খ) জাতীয়তাবাদী চেতনার উৎস:
স্বামী বিবেকানন্দের আদর্শ অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল ভবিষ্যৎ স্বাধীনতা সংগ্রামীদের, যেমন অরবিন্দ ঘোষ, সুভাষচন্দ্র বসু, মহাত্মা গান্ধী প্রমুখদের।
উপসংহার:
স্বামী বিবেকানন্দ ভারতীয় সমাজকে আত্মবিশ্বাস, নৈতিকতা, কর্মপ্রেরণা ও মানবতাবাদে জাগিয়ে তুলেছিলেন।
তিনি ধর্মকে ব্যবহার করেছিলেন কুসংস্কার দূর করতে, এবং জাতীয়তাবাদকে ব্যবহার করেছিলেন আত্মমর্যাদা জাগাতে। তাই বলা যায়—
তিনি ছিলেন ভারতীয় নবজাগরণের এক উজ্জ্বল প্রদীপ, যিনি আত্মবিশ্বাসে আলোকিত করেছিলেন একটি নিপীড়িত জাতিকে।
0 মন্তব্যসমূহ