কার্ল মার্কসের রাষ্ট্র সম্পর্কিত বা রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কিত মার্কসীয় তত্ত্বটি আলোচনা কর |

কার্ল মার্কসের রাষ্ট্র সম্পর্কিত বা রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কিত মার্কসীয় তত্ত্বটি আলোচনা কর |

 কার্ল মার্কসের রাষ্ট্র সম্পর্কিত বা রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কিত মার্কসীয় তত্ত্বটি আলোচনা কর |


>>>>>>>>>>>>> উত্তর <<<<<<<<<<<<

ভূমিকা:

কার্ল মার্কস (1818–1883) ছিলেন একজন জার্মান দার্শনিক, অর্থনীতিবিদ ও সমাজতাত্ত্বিক, যিনি ইতিহাস, সমাজ ও রাষ্ট্রকে শ্রেণীসংগ্রাম এবং উৎপাদন সম্পর্কের ভিত্তিতে ব্যাখ্যা করেন। রাষ্ট্র সম্পর্কে তাঁর ধারণা মূলত ঐতিহাসিক বস্তুবাদশ্রেণীসংঘাত-এর তত্ত্বের উপর প্রতিষ্ঠিত। মার্কস রাষ্ট্রকে কোনও নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখেননি, বরং শাসক শ্রেণির আধিপত্য রক্ষার এক যন্ত্র হিসেবে বিশ্লেষণ করেন।


১. মার্কসীয় রাষ্ট্রতত্ত্বের মূল ভিত্তি:

(ক) শ্রেণীসংগ্রাম:

মার্কসের মতে, ইতিহাস মূলত শ্রেণীসংগ্রামের ইতিহাস। প্রাচীন যুগ থেকে আধুনিক পুঁজিবাদ পর্যন্ত, শাসক ও শোষিত শ্রেণীর মধ্যে দ্বন্দ্বই সমাজ পরিবর্তনের চালিকাশক্তি।

(খ) রাষ্ট্র হলো শ্রেণীশোষণের হাতিয়ার:

রাষ্ট্র কোনো নিরপেক্ষ সংস্থা নয়। বরং এটি শাসক শ্রেণীর অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষার জন্য গঠিত একটি দমনমূলক যন্ত্র (Instrument of Class Domination)।

উদাহরণ: পুঁজিবাদী সমাজে রাষ্ট্র মূলত ধনীদের স্বার্থ রক্ষা করে, শ্রমিকদের নয়।


২. রাষ্ট্রের উৎপত্তি ও বিকাশ (মার্কস ও এঙ্গেলস):

মার্কস এবং ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস তাঁদের গ্রন্থ The Origin of the Family, Private Property and the State -এ ব্যাখ্যা করেন:

(ক) ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও শ্রেণীবিভক্ত সমাজের ফলে রাষ্ট্রের উদ্ভব:

প্রথমে সাম্যবাদী সমাজে রাষ্ট্রের প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু ব্যক্তিগত সম্পত্তির আবির্ভাব ও শোষক-শোষিত শ্রেণীর উদ্ভবের পর, শোষকদের আধিপত্য কায়েম রাখার জন্য রাষ্ট্র গঠিত হয়।

(খ) রাষ্ট্রের বিকাশ ইতিহাস নির্ভর:

রাষ্ট্রের চরিত্র সমাজের অর্থনৈতিক কাঠামোর উপর নির্ভর করে। দাসপ্রথা, সামন্ততন্ত্র ও পুঁজিবাদ — প্রত্যেকটি পর্যায়ে রাষ্ট্র শাসক শ্রেণীর শোষণ বজায় রাখে।


৩. রাষ্ট্রের ভূমিকা মার্কসীয় দৃষ্টিতে:

(ক) দমনমূলক যন্ত্র (Repressive Organ):

রাষ্ট্র হলো পুলিশ, সেনাবাহিনী, আদালত, কারাগার প্রভৃতি ব্যবস্থার সমষ্টি — যা বিরোধী শ্রেণী বা বিদ্রোহ দমন করে।

(খ) আইন ও ন্যায়বিচার:

রাষ্ট্রের আইন ব্যবস্থাও শাসক শ্রেণীর পক্ষে। অর্থাৎ, "আইন সকলের জন্য সমান" শ্লোগানটি প্রকৃতপক্ষে ধনী ও ক্ষমতাবানদের স্বার্থ রক্ষা করে।

(গ) পুঁজিবাদী রাষ্ট্র:

পুঁজিবাদী সমাজে রাষ্ট্র এমনভাবে চলে, যেন তা নিরপেক্ষ — কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা মূলত বুর্জোয়া শ্রেণীর নিয়ন্ত্রণে থাকে।


৪. রাষ্ট্র বিলুপ্তির ধারণা (Withering Away of the State):

মার্কস বিশ্বাস করতেন, শ্রেণীহীন সমাজ প্রতিষ্ঠিত হলে রাষ্ট্রের আর প্রয়োজন থাকবে না। তখন রাষ্ট্র আত্মবিলুপ্ত হবে

দুইটি ধাপ:

১. প্রলেতারিয়েতের একনায়কত্ব (Dictatorship of the Proletariat): – শ্রমিক শ্রেণী সাময়িকভাবে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ নেবে।
২. শ্রেণীহীন সাম্যবাদী সমাজ: – সব শোষণ ও বৈষম্য বিলুপ্ত হলে রাষ্ট্র অপ্রয়োজনীয় হয়ে আত্মপ্রবঞ্চিত হবে।


৫. মার্কসীয় রাষ্ট্রতত্ত্বের প্রভাব:

  • রুশ বিপ্লব (1917), চিনা বিপ্লব (1949), কিউবা বিপ্লব সহ বহু সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনে এই রাষ্ট্রতত্ত্ব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

  • আধুনিক সমাজতত্ত্ব ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিশ্লেষণে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টিকোণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়।


উপসংহার:

কার্ল মার্কস রাষ্ট্রকে একটি শ্রেণীশোষণমূলক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ব্যাখ্যা করেন, যার উদ্দেশ্য শাসক শ্রেণীর আধিপত্য রক্ষা করা। তাঁর মতে, সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমে একটি শ্রেণীহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা হলে রাষ্ট্র ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হবে। এই ধারণা আধুনিক রাজনৈতিক চিন্তায় এক গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব হিসেবে স্থান পেয়েছে।


উক্তি (এঙ্গেলস):
"The state is not abolished. It withers away." – মার্কসীয় রাষ্ট্রতত্ত্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সারাংশ এই বাক্যেই প্রকাশিত।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ