জাতীয়তাবাদ বিকাশে ও আধ্যাত্মিক ধারণায় স্বামী বিবেকানন্দের ভূমিকা সম্পর্কে আলোচনা করো ।
জাতীয়তাবাদ বিকাশে ও আধ্যাত্মিক ধারণায় স্বামী বিবেকানন্দের ভূমিকা
স্বামী বিবেকানন্দ (১৮৬৩–১৯০২) ছিলেন আধুনিক ভারতের এক বিশিষ্ট আধ্যাত্মিক ও রাজনৈতিক চিন্তাবিদ, যিনি ভারতীয় জাতীয়তাবাদ বিকাশে একটি মৌলিক ও গভীর অবদান রেখেছেন। তাঁর চিন্তায় ধর্ম, আধ্যাত্মিকতা এবং দেশপ্রেম পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত ছিল। তিনি আত্মশক্তি, সাংস্কৃতিক গর্ব, এবং নৈতিক উন্নতির মাধ্যমে জাতিকে জাগ্রত করতে চেয়েছিলেন।
✦ ১. জাতীয়তাবাদ বিকাশে স্বামী বিবেকানন্দের ভূমিকা:
ক) সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ:
-
তিনি পশ্চিমের ঔপনিবেশিক মনোভাবের বিরুদ্ধে ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির গৌরবময় অতীত তুলে ধরেন।
-
ভারতীয়দের আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে তিনি বলেন— “উঠো, জাগো, যতক্ষণ না লক্ষ্য অর্জিত হয়, থেমো না।”
খ) জাতীয় আত্মপরিচয় গঠনে ভূমিকা:
-
তিনি জাতিকে মনে করিয়ে দেন যে, তারা দাস নয়; বরং প্রাচীন জ্ঞানের ধারক।
-
তিনি হিন্দু ধর্মের মৌল দর্শনের মাধ্যমে একটি আধ্যাত্মিক ও নৈতিক জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠা করেন।
গ) যুব সমাজের উদ্বুদ্ধকরণ:
-
বিবেকানন্দ বিশ্বাস করতেন, যুবকরাই জাতির ভবিষ্যৎ। তিনি বলেন— “তোমরা নিজেরাই নিজের ভবিষ্যৎ গড়ে তোলো।”
-
তাঁর চিন্তা ভারতীয় যুব সমাজকে জাতীয় দায়িত্ববোধ ও আত্মশক্তিতে উদ্বুদ্ধ করে।
ঘ) ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও ঐক্যবোধ:
-
জাতিগত বিভাজনের পরিবর্তে তিনি সামগ্রিক জাতি গঠনের জন্য ধর্মীয় ঐক্য ও সহিষ্ণুতার উপর জোর দেন।
-
তিনি বিশ্বাস করতেন ভারত সব ধর্মকে গ্রহণ করতে পারে — “সার্বজনীন গ্রহণযোগ্যতার ভূমি”।
✦ ২. আধ্যাত্মিক ধারণায় স্বামী বিবেকানন্দের ভূমিকা:
ক) আত্মজ্ঞান ও মানবসেবাকে ধর্মরূপে উপস্থাপন:
-
তিনি বলেন, “জীবসেবা – শিবসেবা”, অর্থাৎ মানুষের সেবাই ঈশ্বরের সেবা।
-
আধ্যাত্মিকতা যেন নিছক উপাসনা নয়, বরং কর্মের মাধ্যমে আত্মোন্নয়নের পথ।
খ) ধর্মের সার্বজনীনতা:
-
তিনি বিশ্বধর্ম সংসদে (১৮৯৩, শিকাগো) ভারতীয় আধ্যাত্মিকতার মহান বার্তা পৌঁছে দেন।
-
তাঁর মতে, প্রতিটি ধর্মের মূলে আছে মানবতাবাদ, ভালোবাসা ও সহিষ্ণুতা।
গ) বৈদান্তিক দর্শনের প্রচার:
-
তিনি "অদ্বৈত বেদান্ত" তথা সবকিছুর মধ্যে একত্ববোধকে কেন্দ্র করে আত্মা ও পরমাত্মার ঐক্যের কথা প্রচার করেন।
-
এর মাধ্যমে মানুষকে আত্মবিশ্বাস ও আত্মসম্মানবোধে উজ্জীবিত করতে চেয়েছেন।
✦ উপসংহার:
স্বামী বিবেকানন্দের জাতীয়তাবাদ ছিল আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে যুক্ত— যা বাহ্যিক সংগ্রামের চেয়ে আত্মিক শক্তির উপর বেশি গুরুত্ব দেয়। তিনি জাতিকে বলেছিলেন আত্মচর্চা করো, আত্মবিশ্বাসে জাগো, কারণ “শক্তি-ই জীবন, দুর্বলতা-ই মৃত্যু।” তাঁর চিন্তা আজও ভারতীয় জাতীয়তাবাদ, মানবিকতা ও আত্মবিকাশের দিশারূপে কাজ করছে।
0 মন্তব্যসমূহ