ভারতের সংবিধানের প্রস্তাবনা সম্পর্কে যা জান লেখ।
ভারতের সংবিধানের প্রস্তাবনা (Preamble) হল সংবিধানের মুখবন্ধ বা ভূমিকা, যা ভারতের রাষ্ট্রীয় আদর্শ, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যসমূহ সংক্ষেপে তুলে ধরে। এটি সংবিধানের আত্মা হিসেবে বিবেচিত হয়। প্রস্তাবনা ভারতের সংবিধান প্রণেতাদের উদ্দেশ্য, দর্শন ও মূলনীতি প্রকাশ করে, যা ভারতের গণতান্ত্রিক কাঠামোকে ভিত্তি হিসেবে ধারণ করে। নিচে ভারতের সংবিধানের প্রস্তাবনা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো
প্রস্তাবনার পাঠ (মূল ইংরেজি রূপান্তর):
“We, the people of India, having solemnly resolved to constitute India into a Sovereign Socialist Secular Democratic Republic and to secure to all its citizens:
JUSTICE, social, economic and political;
LIBERTY, of thought, expression, belief, faith and worship;
EQUALITY, of status and of opportunity; and to promote among them all
FRATERNITY, assuring the dignity of the individual and the unity and integrity of the Nation;
IN OUR CONSTITUENT ASSEMBLY this 26th day of November, 1949, do HEREBY ADOPT, ENACT AND GIVE TO OURSELVES THIS CONSTITUTION.”
প্রস্তাবনার বৈশিষ্ট্য ও তাৎপর্য:
১. জনগণের দ্বারা রচিত (We, the people of India):
প্রস্তাবনার শুরুতেই বলা হয়েছে যে, "আমরা ভারতের জনগণ", যা স্পষ্ট করে যে সংবিধানের সর্বোচ্চ ক্ষমতা জনগণের হাতে। এটি ভারতের গণতান্ত্রিক ভিত্তিকে সুসংহত করে।
২. ভারতের রাষ্ট্রীয় রূপ:
প্রস্তাবনায় ভারতকে পাঁচটি মৌলিক পরিচয়ে চিহ্নিত করা হয়েছে:
Sovereign (সার্বভৌম): ভারত একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। বিদেশি কোনো শক্তি ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারে না।
Socialist (সমাজতান্ত্রিক): সমাজতন্ত্রের মাধ্যমে সম্পদের ন্যায্য বণ্টন এবং সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ভারত প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এটি ১৯৭৬ সালের ৪২তম সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে যুক্ত হয়।
Secular (ধর্মনিরপেক্ষ): ভারত কোনও নির্দিষ্ট ধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে গ্রহণ করে না। সমস্ত ধর্মের প্রতি সমান শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা হয়। এটিও ৪২তম সংশোধনে যুক্ত হয়েছে।
Democratic (গণতান্ত্রিক): জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধির মাধ্যমে শাসন চলে। নির্বাচন স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও সার্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে হয়।
Republic (প্রজাতান্ত্রিক): রাষ্ট্রপ্রধান জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হন, বংশগত শাসনের কোনো সুযোগ নেই।
৩. লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য:
প্রস্তাবনায় ভারতের নাগরিকদের প্রতি রাষ্ট্রের মৌলিক প্রতিশ্রুতি তুলে ধরা হয়েছে:
Justice (ন্যায়বিচার): সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করা হয়েছে।
Liberty (স্বাধীনতা): চিন্তা, মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম ও উপাসনার স্বাধীনতা প্রদান নিশ্চিত করা হয়েছে।
Equality (সমতা): সামাজিক মর্যাদা ও সুযোগের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের সমান অধিকার থাকবে।
Fraternity (ভ্রাতৃত্ববোধ): সমস্ত নাগরিকের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ সৃষ্টি করে ব্যক্তির মর্যাদা এবং জাতির ঐক্য ও অখণ্ডতা রক্ষা করা।
৪. সংবিধান প্রণয়নের দিন:
২৬ নভেম্বর, ১৯৪৯-এ সংবিধান গৃহীত হয় এবং ২৬ জানুয়ারি, ১৯৫০ থেকে কার্যকর হয়। ২৬ নভেম্বর এখন ‘সংবিধান দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়।
প্রস্তাবনার আইনগত মর্যাদা:
প্রথমদিকে ধারণা ছিল যে প্রস্তাবনা কেবল সংবিধানের ভূমিকা মাত্র, এর নিজস্ব কোনও আইনি বল নেই। তবে ১৯৭৩ সালের কেশবানন্দ ভারতী মামলায় সুপ্রিম কোর্ট রায় দেয় যে, প্রস্তাবনা সংবিধানের অংশ এবং এটি সংবিধানের মূল কাঠামো (basic structure) নির্দেশ করে। ফলে প্রস্তাবনায় উল্লিখিত আদর্শগুলি বিচারব্যবস্থায় বিবেচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।
উপসংহার:
ভারতের সংবিধানের প্রস্তাবনা একটি ছোট কিন্তু অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ অংশ। এটি ভারতের গণতান্ত্রিক কাঠামো, ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র, সমাজতান্ত্রিক দর্শন ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক। প্রস্তাবনা কেবল সংবিধানের নীতি নির্ধারণ করে না, বরং ভারতের রাষ্ট্রীয় জীবন ও নাগরিকদের জন্য একটি নৈতিক পথনির্দেশক হিসেবেও কাজ করে। এটি ভারতীয় গণতন্ত্রের মূলে থাকা মূল্যবোধগুলির প্রতিচ্ছবি, যা একটি সাম্যবাদী, ন্যায়ভিত্তিক ও ঐক্যবদ্ধ জাতি গঠনের জন্য অপরিহার্য।
0 মন্তব্যসমূহ