রাজ্যসভার গঠন, ক্ষমতা ও পদমর্যাদা আলোচনা কর।
ভূমিকা:
ভারতের সংসদ দুটি কক্ষ নিয়ে গঠিত—লোকসভা (নিম্নকক্ষ) এবং রাজ্যসভা (উচ্চকক্ষ)। রাজ্যসভা হলো ভারতের সংসদের উচ্চকক্ষ, যা যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো অনুযায়ী রাজ্যগুলির প্রতিনিধিত্ব করে। এটি এক স্থায়ী সভা, যা কখনো ভাঙা হয় না, বরং প্রতি দুই বছর অন্তর এক-তৃতীয়াংশ সদস্য অবসর গ্রহণ করেন এবং নতুন সদস্য নির্বাচিত হন।
রাজ্যসভার গঠন:
১. সদস্য সংখ্যা:
-
ভারতীয় সংবিধানের ৮০ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাজ্যসভার সর্বাধিক সদস্য সংখ্যা হতে পারে ২৫০ জন।
-
তার মধ্যে:
-
২৩৮ জন সদস্য রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল থেকে নির্বাচিত হন।
-
১২ জন সদস্য রাষ্ট্রপতি মনোনীত করেন।
-
-
২. নির্বাচন পদ্ধতি:
-
নির্বাচিত সদস্যরা রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলির বিধান পরিষদের সদস্যদের মাধ্যমে নির্বাচিত হন।
-
এই নির্বাচন হয় একক স্থানান্তরযোগ্য ভোট (single transferable vote) পদ্ধতিতে, আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ভিত্তিতে।
-
মনোনীত ১২ জন সদস্য সেইসব বিশিষ্ট ব্যক্তিরা যাঁরা সাহিত্য, বিজ্ঞান, শিল্প বা সমাজসেবার ক্ষেত্রে অবদান রেখেছেন।
৩. যোগ্যতা:
-
ভারতীয় নাগরিক হতে হবে।
-
ন্যূনতম বয়স হতে হবে ৩০ বছর।
-
সংবিধান অনুযায়ী অন্যান্য শর্তও পূরণ করতে হবে।
রাজ্যসভার ক্ষমতা:
১. বিধান প্রণয়নের ক্ষমতা:
-
রাজ্যসভা লোকসভার সঙ্গে সমভাবে সাধারণ বিল (ordinary bills) প্রণয়নে অংশগ্রহণ করে।
-
যদি কোনো বিল উভয় কক্ষে গৃহীত হয়, তবেই তা আইন হয় (অর্থবিল ছাড়া)।
২. অর্থ বিষয়ক ক্ষমতা:
-
অর্থবিল শুধুমাত্র লোকসভায় উত্থাপিত হতে পারে।
-
রাজ্যসভা অর্থবিলকে ১৪ দিনের মধ্যে সুপারিশ করতে পারে, কিন্তু তা মানা বা না মানার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত লোকসভার।
৩. সংবিধান সংশোধনের ক্ষমতা:
-
রাজ্যসভা এবং লোকসভা—উভয় কক্ষের অনুমোদন প্রয়োজন হয় সংবিধান সংশোধনে।
-
সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে রাজ্যসভা লোকসভার সমান গুরুত্বপূর্ণ।
৪. বিশেষ ক্ষমতা:
-
সংবিধানের ২৪৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, যদি রাজ্যসভা দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেয় যে কেন্দ্র সরকার কোনো রাজ্য-সংক্রান্ত বিষয়ে আইন তৈরি করতে পারে, তাহলে সংসদ তা করতে পারে।
-
৩১২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, রাজ্যসভা চাইলে নতুন অল ইন্ডিয়া সার্ভিস (All India Service) গঠন করতে পারে।
৫. রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা প্রয়োগে ভূমিকা:
-
রাষ্ট্রপতি যদি জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন, তবে তা অনুমোদনের জন্য রাজ্যসভার অনুমতি প্রয়োজন হয় (যদি লোকসভা ভেঙে দেওয়া হয়)।
-
রাষ্ট্রপতির দ্বারা জারিকৃত অধ্যাদেশ বা আন্তর্জাতিক চুক্তির অনুমোদন রাজ্যসভাও দেয়।
রাজ্যসভার পদমর্যাদা:
-
রাজ্যসভা একটি স্থায়ী কক্ষ। এটি কখনো ভেঙে যায় না। তাই এটি এক প্রকার নিরবিচ্ছিন্ন সংসদীয় ধারার প্রতীক।
-
রাজ্যসভায় সভাপতির দায়িত্বে থাকেন উপরাষ্ট্রপতি, যিনি স্বয়ং নির্বাচিত একজন সাংবিধানিক পদাধিকারী।
-
রাজ্যসভা অনেক সময় রাষ্ট্রপতির কার্যাবলীতে সঠিক পরামর্শদানের মাধ্যমে দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
-
যদিও রাজ্যসভার আইন প্রণয়ন ক্ষমতা কিছুটা সীমিত (বিশেষত অর্থবিলের ক্ষেত্রে), তবুও এটি একটি আলোচনামূলক, পর্যালোচনামূলক ও পরামর্শমূলক কক্ষ হিসেবে গণতান্ত্রিক ভারসাম্য রক্ষা করে।
উপসংহার:
রাজ্যসভা ভারতের সংসদীয় ব্যবস্থায় একটি অপরিহার্য অঙ্গ। এটি কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে সমন্বয় রক্ষা করে এবং সংবিধানের মৌলিক কাঠামো বজায় রাখতে সহায়ক হয়। রাজ্যসভা শুধু আইন প্রণয়নই নয়, বরং সংবিধান রক্ষা, সরকারের কাজের বিশ্লেষণ এবং রাজ্যগুলির স্বার্থ সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই বলা যায়, রাজ্যসভা ভারতীয় গণতন্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ।
0 মন্তব্যসমূহ