আধুনিক ভারতীয় রাষ্ট্রচিন্তায় গণতান্ত্রিক চিন্তাধারার বিকাশে জহরলাল নেহেরু দৃষ্টিভঙ্গি আলোচনা করো।
ভূমিকাঃ
জওহরলাল নেহেরু (১৮৮৯–১৯৬৪) ছিলেন আধুনিক ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী এবং এক বিশিষ্ট রাষ্ট্রচিন্তাবিদ। তিনি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম প্রধান নেতা হয়েও শুধু রাজনীতিক ছিলেন না; ছিলেন এক বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদী ও মানবতাবাদী চিন্তাবিদ। তাঁর রাষ্ট্রচিন্তা গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র, ও মানবিক বিকাশের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল। আধুনিক ভারতীয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রচিন্তার বিকাশে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য।
✦ ১. গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে বিশ্বাস:
নেহেরু গণতন্ত্রকে শুধুমাত্র একটি রাজনৈতিক পদ্ধতি হিসেবে দেখেননি, বরং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের অংশ হিসেবে দেখেছিলেন।
-
তিনি চেয়েছিলেন:
-
মত প্রকাশের স্বাধীনতা
-
রাজনৈতিক অংশগ্রহণের অধিকার
-
আইন ও বিচারব্যবস্থার সমতা
-
গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাধীনতা
-
🔹 উক্তি:
"Democracy is good. I say this because other systems are worse."
✦ ২. ধর্মনিরপেক্ষতা ও উদারনৈতিক রাষ্ট্রচিন্তা:
নেহেরু বিশ্বাস করতেন, ভারত একটি বহু-ধর্ম, বহু-ভাষা ও বহু-জাতিগোষ্ঠীর দেশ।
গণতন্ত্রকে কার্যকর করতে হলে রাষ্ট্রকে অবশ্যই ধর্মনিরপেক্ষ হতে হবে।
-
তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিতে:
-
রাষ্ট্র কোনো ধর্মকে প্রাধান্য দেবে না
-
সব ধর্মের প্রতি সমান সম্মান থাকবে
-
ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধা জাগ্রত হবে
-
✦ ৩. বিজ্ঞানমনস্কতা ও যুক্তিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থা:
নেহেরু ভারতের ভবিষ্যৎ গড়ার জন্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে রাষ্ট্রনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে স্থাপন করেন।
তিনি যুক্তিবাদ, তথ্যভিত্তিক সিদ্ধান্ত, ও আধুনিক শিক্ষার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক চেতনা জাগাতে চেয়েছিলেন।
-
পরিকল্পনা কমিশন ও বিজ্ঞান গবেষণা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে রাষ্ট্রের মধ্যে গণতান্ত্রিক ও আধুনিক প্রশাসনের ভিত্তি নির্মাণ করেন।
✦ ৪. সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রের ধারণা:
নেহেরু গণতন্ত্রের সঙ্গে সমাজতন্ত্রের মিলন ঘটাতে চেয়েছিলেন।
তিনি বিশ্বাস করতেন রাজনৈতিক গণতন্ত্র তখনই সফল হবে, যখন অর্থনৈতিক সাম্য ও সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা যাবে।
-
"মিশ্র অর্থনীতি", "কল্যাণমূলক রাষ্ট্র", "পরিকল্পিত উন্নয়ন" ইত্যাদি তাঁর সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির অংশ ছিল।
✦ ৫. সংবিধান ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান গঠনে অবদান:
-
নেহেরু সংবিধানের প্রস্তাবনাতেই গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র—এই মূলনীতিগুলোকে স্থান দিতে চেয়েছিলেন।
-
সংসদ, নির্বাচন কমিশন, স্বাধীন বিচারব্যবস্থা, সংবাদমাধ্যম প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানগুলোর গুরুত্ব প্রতিষ্ঠা করেন।
✦ উপসংহার:
জওহরলাল নেহেরু গণতান্ত্রিক ভারত গঠনের জন্য একটি মানবিক, ধর্মনিরপেক্ষ, বিজ্ঞানমনস্ক এবং সমতার ভিত্তিতে রাষ্ট্রচিন্তার পথপ্রদর্শক ছিলেন। তাঁর চিন্তায় গণতন্ত্র কেবল ভোটের মাধ্যমেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি একটি জীবনচর্চা ও সামাজিক আদর্শ, যা ন্যায়, সমতা ও সম্মানের উপর ভিত্তি করে সমাজকে গড়ে তোলে।
0 মন্তব্যসমূহ